ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের ফলে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সাথে পতন হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের। ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার গঠনের পর থেকে সময় যত অতিবাহিত হয়েছে ততই প্রকাশ পেয়েছে বিগত সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অর্থ লোপাটের ভয়ংকর চিত্র। ফলে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহনের পর নতুন-নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে আর্থিক খাতসহ সকল ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন বর্তমান সরকারকে একাধিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে নতুন রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে নতুন সরকারকে।
স্বাধীনতার পর দেশে প্রতিটা সরকারের আমলেই দুর্নীত হয়েছে। কিন্তু বিগত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসন আমলে দেশে যে দুর্নীতি ও টাকা পাচার হয়েছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে বর্তমানে দেশে ৯ টি ব্যাংক গ্রাহকের আমানত ফেরত দেবার মত পরিস্থিতিতে নেই। দেশের একাধিক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ ব্যাংক থেকে লুট করেছে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেশের আর্থিক খাতকে সংস্কারের জন্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ এর সম্মানিত ফেলো ড.দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আগামী তিন মাসের মধ্যে কমিটি আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন বলে জানানো হয়েছে। আর্থিক খাতকে সংস্কার করা বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারমূলক চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান প্রাণ শক্তি হলো তৈরি পোশাক শিল্প। চীনের পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮৪ শতাংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে জিডিপিতে যার অবদান ১১ শতাংশ। পোশাক শিল্পে প্রায় ৫০ লক্ষ শ্রমিক সরাসরি সম্পৃক্ত যার মধ্যে ৬২ শতাংশ নারী। পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে অন্যান্য ব্যবসায় বাণিজ্য মিলিয়ে প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করে এই খাতের উপর। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের অন্যান্য জায়গার মতো পোশাক শিল্পেও অরাজকতা বিরাজ করছে। এই সময় অন্যান্য শ্রেণী পেশার মানুষের ন্যায় পোশাক শ্রমিকরাও তাদের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের সাগর-রুনী মিলনায়তনে পোশাক শিল্পে অরাজকতা বিরাজ করছে বলে দাবি করেন জাতীয় শ্রমিক ঐক্য। বিগত ২ মাসে বাংলাদেশে প্রাই একশটির মতো ছোট বড় কারখানা বন্ধ হয়েছে। আমেরিকার একাধিক কোম্পানি তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করে অন্য দেশে নিয়ে যায়। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে পোশাক শিল্পকে উজ্জীবিত রাখা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সাধারন মানুষের উপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ জনরোষের মুখে পড়ে। একই সময় বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থানাগুলোই হামলার করে এতে ৪৬ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। আন্দোলনের পর পুলিশ বাহিনীর আত্মবিশ্বাস তলানীতে এসে ঠেকেছে। এমনকি প্রথম ১০ দিন ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে কারণ ওই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ব্যারাকে ফিরতে হয়েছে। এখনো অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগদান করেনি। দেশের এই ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সংস্কার করাও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।
দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয় সচিবালয়কে কেন্দ্র করে। স্বাধীনতার পর দেশের শাসক দলগুলো তাদের অনুগত ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে সচিবালয় নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। নিজেদের অবৈধতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত কর্মকর্তাকে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি দিয়েছিল আওয়ামীলীগ সরকার। যেখানে আইনের তোয়াক্কা না পরে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে । কিন্ত ৮ আগস্ট ড. মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে দুর্নীতিগ্রস্ত অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী আত্মগোপনে চলে যায় আবার অনেকেই চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়। এই পরিস্থিতিতে দেশের শাসন কার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য নতুন করে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই সময় পদ বঞ্চিত কর্মকর্তারা মুখ্য সচিবের উপর আক্রমণ করে। আবার ঘুষের বিনিময়ে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার খবরও আমরা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখতে পেয়েছি। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক শাসন কার্য পরিচালনা করাও একটি চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে যে বাজার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল তার পুরোনো রূপ আবার আমরা দেখতে পেয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কিছুদিন বাজার সিন্ডিকেটের মূল হোতারা আত্মগোপনে ছিল। সে সময়ের সুফলও এ দেশের সাধারণ মানুষ ভোগ করেছিল। কারণ ওই সময় নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। কিন্তু সময় যত অতিবাহিত হয়েছে বাজার সিন্ডিকেটের মূল হোতারা পুরোনো রূপে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার পরিষদের ম্যাজিস্ট্রেট ডিমের বাজারে ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করার পর দিনই প্রতি ডজন ডিমে ৫০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বর্তমান সরকার নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম তাদের করায় ক্ষমতার মধ্যে রাখবে।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা এই সরকারের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন করলে আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনের অংশগ্রহণ সম্ভবপর নয়। কারণ ছাত্র জনতার আন্দোলন প্রতিহত করতে গিয়ে ১৪০০ মতো মানুষ হত্যা করেছে। যার বিচার কার্য চলমান রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিচারকার্য সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভবপর নয়। এমন প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছে, রাষ্ট্র সংস্কারের পর নির্বাচন আয়োজন করা হবে। যা দেশ এবং দেশের বাইরে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
লেখক: ব্যাংকার ও সমাজকর্মী
hmmaruf1991@gmail.com