পার্ল হারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিভুক্ত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত একটি নৌ ও বিমান ঘাঁটি।সামরিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। পার্ল হারবার হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নানাবিধ ঘটনাগুলোর মধ্যে জাপান কর্তৃক ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবার আক্রমণ অন্যতম। পার্ল হারবার আক্রমণ ছিল ইতিহাসের একটি অপ্রত্যাশিত সামরিক অভিযান। আক্রমণটি জাপান সাম্রাজ্যের জেনারেল হেডকোয়ার্টারের অপারেশন জেড এর পরিকল্পনায় হাওয়াই অপারেশন বা অপারেশন (এআই)নামে পরিচিত। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা তেমন ছিল না। ১৯২০-এর দশক থেকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের আওতায় উভয় দেশই সচেতন ছিল। যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল প্রবল। মূলত জাপান ছিল আমদানি নির্ভর একটি দেশ। তৎকালীন সময় দেশটির মোট চাহিদার ৯০% আমদানি করতে হতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল জাপানের প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। কিন্তু ১৯৩১ সালে এশিয়ার পরাশক্তি হিসেবে জাপানের আত্মপ্রকাশ, জাপান কর্তৃক মাঞ্চুরিয়া দ্বীপ অধিগ্রহণ, চীনের ভূমি দখলের ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক খুব দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪০ সালে জাপান কর্তৃক ফরাসি ইন্দোচীন জোরপূর্বক ও অন্যায়ভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করে। জাপানের এই অবন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সাথে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং জাপানে প্রেরণের জন্য প্রস্তুতকৃত উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, পেট্রোলিয়াম জাতীয় তরল পদার্থ, মেশিনের যন্ত্রাংশ, স্টিলের পাত রপ্তানির উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করে। এই ঘটনায় তৎকালীন জাপানী রাষ্ট্রদূত ১৯৪০ সালের ৮ অক্টোবর সেক্রেটারি হালের কাছে তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এর ফলে যা হবে তা অবন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ।
অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর ছয়টি বিমান বাহিনীর জাহাজ থেকে ৩৫৩ টি জাপানি যুদ্ধবিমান, বোমারু বিমান, টর্পেডো বিমান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবাল বিমান ঘাঁটিতে একযোগে আক্রমণ করে। পার্ল হারবাল আক্রমণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৮৮ টি যুদ্ধবিমান ৮ টি বিমানবাহী রণতরী ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও চারটি যুদ্ধজাহাজ উদ্ধার করে মেরামত শেষে পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই আক্রমণে ২৪০২ জন মার্কিন সেনা নিহত হয় এবং ১২৮২ জন আহত হয়। অপরদিকে আক্রমণকারী জাপানী বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল খুবই নগণ্য। তাদের ২৯ টি যুদ্ধবিমান এবং পাঁচটি সাবমেরিন ধ্বংস হয়। নিহত এবং আহত সেনার সংখ্যা ছিল মাত্র ৬৫ জন। কাজু সাকামাকি নামের এক জাপানি সৈনিক আটক হয়।
ফলশ্রুতিতে ১৯৪১ সালের ৮ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অপ্রত্যাশিতভাবে অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সমর্থনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক শীতলীকরণ পর্যায়ে পৌঁছায়। নীতিগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করাই ছিল জাপানি বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পার্ল হারবার আক্রমণে কৌশলগত কারণে যুদ্ধের কোন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেনি জাপান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, কোন প্রকার সতর্কবার্তা ছাড়া জাপানী বাহিনী পার্ল হারবার আক্রমণ করবে না। তবে মার্কিন বাহিনী চিন্তিত ছিল ফিলিপাইনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি নিয়ে। কিন্তু জাপানি বাহিনী ফিলিপাইনে আক্রমণ না করে সরাসরি পার্ল হারবারে আক্রমণ করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এই ঘটনাকে কুখ্যাত দিন হিসেবে বর্ণনা দেন। জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল – আমেরিকার যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করা, জাপানের সামরিক অবস্থান মজবুত করা,ঐক্যবদ্ধ আমেরিকানদের নৈতিক মনোবল বহুলাংশে হ্রাস করা এবং নীতিগতভাবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রবল পরাশক্তি হিসেবে জাপানের আসীন হওয়া।