- বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ শীর্ষক অনলাইন ভিত্তিক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে একাধিক প্রথম সারির গণমাধ্যম। যেখানে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মতামত দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ছাত্র রাজনীতিই কী নিরাপদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান অন্তরায়?
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি থাকা দরকার কিংবা দরকার নয় সেই বিষয়ে মতামত দেবার আগে, ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে সেটা জানা প্রয়োজন। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ৬৯’এর গণ-অভ্যুত্থান, ছাত্র সমাজের ১১ দফা, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৯০ সালের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, এমনকি ২০২৪ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র সমাজের ভূমিকা জননন্দিত। এদেশের সকল সফলকাম আন্দোলনে ছাত্র সমাজ মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। মূলত ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, ছাত্র রাজনীতির কাঠামো সংস্করণ প্রয়োজন।
- ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, ছাত্র রাজনীতি শুধুমাত্র ছাত্রদের অধিকার আদায়ের প্রধান মাধ্যম নয় বরং এটি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতিরও মাধ্যম। পূর্বের ছাত্রনেতারা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ছিল। তারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও অধিকার সচেতন ছিল। দেশ ও দেশের মানুষের স্বাধিকার ও অধিকার আদায়ের তীব্র আখাংকা ছিল ছাত্রনেতাদের মধ্যে।
- কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির যে চর্চা বিদ্যমান তা পূর্বের ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ইতিহাস থেকে অনেকটা বিচ্যূত্ । অতীতে ছাত্র রাজনীতি যেখানে গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করত, সেখানে বর্তমান ছাত্র সংগঠন গুলো সহিংসতা ও দুর্নীতিতে লিপ্ত এবং দলীয় স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন গুলো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে। ছাত্র সংগঠন গুলো রাজনৈতিক দলের অংশ হওয়ায়, মূল দলের ডাকা সভা সমাবেশ, হারতাল অবরোধ এমনকি সহিংসতামূলক কর্মকান্ডে ছাত্র সংগঠন গুলো মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। জনসমাজের কোনো দাবি বা দেশের ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র সংগঠন গুলো অতীতের ন্যায় গৌরবময় ভূমিকা পালন করতে পারছেনা। বর্তমানে ছাত্র সংগঠন গুলোর নেতাদের দেখা যায় টেন্ডারবাজিতে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে, প্রতিপক্ষকে হত্যার মত গর্হিত কাজে।
- প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে রাজনৈতিক দলের হাইকমান্ড শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিজেদেরকে আইনের উর্ধে ভেবে থাকে। কারণ তাদের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক দলের রাঘব বোয়ালেরা। সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ছাত্র সংগঠন গুলোর নেতারা তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ পড়াশোনা বাদ দিয়ে নীতিবর্জিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক মাফিয়ারা ছাত্রদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। ছাত্রদের রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ববৃন্দ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র রাজনীতির অতীত ঐতিহ্যকে পদদলিত করেছে। সেই সাথে হত্যা করেছে ছাত্রদের দেশাত্মবোধ ও মানবিক মূল্যবোধকে।
- ছাত্র রাজনীতির এই অবনতি ও সহিংসতা বিবেচনায় অনেকেই মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। তাদের মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনীতি না থাকলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আরো বেশি মনোযোগী হতে পারবে। এতে করে শিক্ষারমান আরো উন্নত হবে।
- এই সমস্ত ঘটনা প্রবাহ বিবেচনা করে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা মোটেও সমীচীন হবে না। কেননা আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত রোগের চিকিৎসা দেওয়া, রোগীকে নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো গণতন্ত্র চর্চার প্রানকেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীরা নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আর একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রধান নিয়ামক। ছাত্র রাজনীতি গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক কেননা ছাত্র রাজনীতি নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের জন্য সহায়তা করে এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলে। সুষ্ঠ ছাত্র রাজনীতি বিকাশের জন্য রাজনীতিবিদদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। ছাত্র রাজনীতির জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ দিতে হবে। ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদেরকে রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন না ভেবে, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এর জন্য রাজনৈতিক দলকে আরো পরিশুদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তাই ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধ না করে, ছাত্র সংগঠনের কাঠামোতে সংস্কার করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হবে।
- লেখক : ব্যাংকার ও সমাজকর্মী
- hmmaruf1991@gmail.com
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।